প্রিন্ট এর তারিখঃ ২৯ মার্চ, ২০২৪ ১২:৪৫ অপরাহ্ন || প্রকাশের তারিখঃ ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের ঢল

শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের ঢল

ডেস্ক রিপোর্ট: মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করার নজির পৃথিবীতে আর নেই। বাঙালি সেই ভাষা বীরদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অভিমুখে হাজারো মানুষের ঢল নেমেছে।  ৫২’র ভাষা আন্দোলনে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রাত ১২টা ১ মিনিট থেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতারের বহির্বিভাগের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে থাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানুষ আসতে থাকেন। তবে ভোরের আলো পূর্ব দিগন্তে উঁকি মারার সঙ্গে সঙ্গে মানুষজন ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আজিমপুর কবরস্থান ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছুটে আসেন। বেলা গড়াতেই বাড়তে থাকে মানুষের ঢল। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের অদূরে পলাশীর মোড়ে জড়ো হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তল্লাশি শেষে তারা সারিবদ্ধভাবে ভেতরে প্রবেশ করেন।

করোনা পরিস্থিতির কারণে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর একুশের প্রথম প্রহরে মানুষের উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক কম। এ ছাড়া সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী এবার শহীদ মিনারের মূল বেদিতে একসঙ্গে পাঁচজন শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন- এমন নিয়মে রাতে ভিড় কম হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভিড় ক্রমেই বাড়তে থাকে। এ সময় মহামারি করোনাকালীন ঝুঁকি এড়াতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার যে নির্দেশনা স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা দিয়েছেন তা মানার বালাই দেখা যায়নি। মাইকে বার বার মাস্ক ছাড়া কেউ ভেতরে প্রবেশ করবেন না বলা হলেও অনেককেই মাস্ক ছাড়া জটলা পাকিয়ে শহীদ মিনার অভিমুখে ছুটে যেতে দেখা যায়।

ফুলেল শ্রদ্ধা জানাতে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা জানাতে একা কিংবা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অনেকেই ফুলেল শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। এক সময় একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ছুটে আসতে দেখা গেলেও সময়ের পরিক্রমায় এখন আর তেমনভাবে খালি পায়ে কাউকে হেঁটে হেঁটে আসতে দেখা যায়।

সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, বলতে গেলে প্রায় সবাই জুতা পায়েই হেঁটে যাচ্ছেন। তারা শহীদ মিনারের মূল বেদিতে ওঠার আগে জুতা হাতে করে যাচ্ছেন। এছাড়া শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে যাওয়ার আগে সেলফি তোলার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে দেখা যায়। সময় নিয়ে মোবাইল ফোনে ভিডিও ও ছবি তোলায় অনেকটা সময় ব্যয় করতে দেখা যায়।

বাঙালির একুশ যেভাবে সবার হল

ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন অবসানের পর ভারতকে মাঝে রেখে পূর্ব ও পশ্চিমে দুটি অংশ নিয়ে পাকিস্তান নামে যে রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছিল, তাতে শুরুতেই নিপীড়ণের শিকার হয় বাঙালিরা। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে ফুঁসে ওঠে বাঙালি; ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বুকের রক্ত ঢেলে তারা ছিনিয়ে আনে মায়ের ভাষার অধিকার।

দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হওয়ার পরপরই ১৯৪৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। সে বছরই পাকিস্তানের প্রথম মুদ্রা, ডাকটিকেট, ট্রেনের টিকেট, পোস্টকার্ড থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়।

পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বাঙালি কর্মকর্তারা তার প্রতিবাদ করেন। মাতৃভাষার বাংলার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে একাট্টা হতে শুরু করেন ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীরা। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস এবং অন্যান্য দলের সমন্বয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১১ মার্চের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শেখ মুজিবসহ অনেক ভাষাসৈনিক সচিবালয়ের সামনে থেকে গ্রেপ্তার হন এবং ১৫ মার্চ মুক্তি পান।

মুক্তি পাওয়ার পরদিন, অর্থাৎ ১৬ মার্চ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পুনরায় ছাত্ররা প্রাদেশিক পরিষদ ভবন ঘেরাও করে, সেখানে পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকেই আহত হন। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক সমাবেশে ঘোষণা করেন- 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা'। সেই সমাবেশেই সম্মিলিত প্রতিবাদ জানান বাঙালিরা।

ভাষা-আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনের রূপ দিতে দেশব্যাপী সফরসূচি তৈরি করে ব্যাপক প্রচারে অংশ নেন বঙ্গবন্ধু। সেই আন্দোলনের মধ্যে তিন দফা গ্রেপ্তার হয়ে তাকে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কারাগারে কাটাতে হয়। এর মধ্যেই ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় এসে খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টনের সমাবেশে জিন্নাহর কথার পুনরাবৃত্তি করেন। এরপর ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির প্রতিবাদ রূপ নেয় অগ্নিস্ফূলিঙ্গে।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ থেকেও ভাষাসৈনিক ও ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে যোগযোগ রাখছিলেন বঙ্গবন্ধু, আন্দোলনকে বেগবান করার নানা পরামর্শ দিচ্ছিলেন। ৩ ফেব্রুয়ারি তিনজন দূত মারফত তিনি খবর পাঠান, ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল ডাকতে হবে এবং মিছিল করে ব্যবস্থাপক পরিষদের সভাস্থল ঘেরাও করতে হবে। ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিল শেষে এই ঘোষণা জানিয়ে দেওয়া হয়। সেই পর্যায়ে শেখ মুজিব কারাগারে অনশনের ঘোষণা দিলে ১৫ ফেব্রুয়ারি কারা কর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের বাজেট অধিবেশন। সেজন্যই সেদিন ধর্মঘট ডাকতে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর ধর্মঘট প্রতিহত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। সেই ১৪৪ ধারা ভেঙেই সেদিন মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায় বাংলার দামাল ছেলেরা। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্দেশে মিছিলের ওপর পুলিশের গুলি চলে, শহীদ হন রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত, শফিউদ্দীন, সালামসহ আরও অনেকে।

এর দুই বছর পর ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকার করে প্রস্তাব গ্রহণ করে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি কার্যকর হতে লেগেছিল আরও দুই বছর। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনেই তৈরি হয়েছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের পথ, যে পথ ধরে বাঙালি এগিয়ে যায় স্বাধীনতার সংগ্রামে, পাকিস্তান থেকে আলদা রাষ্ট্র হয়ে একাত্তরে আত্মপ্রকাশ ঘটে বাংলাদেশের।

১৯৯৮ সালে কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপনের জন্য জাতিসংঘে আবেদন করেন। পরের বছর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ১৮৮টি দেশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রস্তাবে সমর্থন জানায়। পরে ২০১০ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হয়, প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।

ভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের দিনটি তাই আজ বিশ্বের সব ভাষাভাষীর অধিকার রক্ষার দিন।

 

 

/ভো

প্রিন্ট নিউজ