প্রিন্ট এর তারিখঃ ০৪ মে, ২০২৪ ০৩:১৫ পূর্বাহ্ন || প্রকাশের তারিখঃ ৩০ জুলাই, ২০১৯

চলে গেলেন ক্রিকেটের রোল মডেল

ফোনের ওপাশের কণ্ঠস্বর কিছুটা যেন কেঁপে উঠল। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলে উঠলেন কিংবদন্তিতুল্য ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিন, ‘হি ওয়াজ মাই ফার্স্ট ক্যাপ্টেন। ’ সালাউদ্দিন যার কথা বললেন তিনি শামিম কবির। বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেট অধিনায়ক হিসেবে নামটা লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। গতকাল সকালে না ফেরার দেশে চলে গেছেন শামিম কবির। তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এভাবেই বিষাদে ভরে ওঠে দেশের ফুটবলের স্বর্ণ সময়ের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা সালাউদ্দিনের মন। ফুটবলার হিসেবে তার জগৎজোড়া খ্যাতি। কিন্তু ক্রিকেটার হিসেবেও সুনাম কুড়িয়েছিলেন সালাউদ্দিন। খেলতেন আজাদ বয়েজের হয়ে। সে সুবাদেই শামিম কবিরকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে, ‘শামিম ভাই আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। আমার চোখে তিনিই সেরা অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে অসংখ্য ম্যাচ খেলেছি। আমি ব্যাটিং করতাম তিন নম্বরে। আর শামিম ভাই ছিলেন ওপেনার। ফলে অনেক ম্যাচে তার সঙ্গে অনেক অনেক জুটি গড়ে খেলেছি।’

খুবই সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে আসা শামিম ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। বিলেতি কায়দায় চলন-বলন, বেশভূষায় অসামান্য ব্যক্তিত্ব আলাদা করে রাখত তাকে। সে কথাই বললেন এ যাবৎকালে স্টাইলিশ ফুটবলারখ্যাত সালাউদ্দিন, ‘তার মতো স্টাইলিশ ওপেনার আমি আর দেখিনি। অধিনায়কের সব গুণাবলির অধিকারী ছিলেন তিনি।’

ফুটবলের জনপ্রিয়তা যখন আকাশছোঁয়া, ক্রিকেট যখন এ দেশের মানুষ ঠিকভাবে বোঝেই না, ঠিক তখনই শামিম কবিররা এ দেশের ক্রিকেটের হাল ধরেছিলেন। তৎকালীন আজাদ বয়েজ ছিল ক্রিকেটের তীর্থভূমি। সেই ক্লাবের সফল অধিনায়ক শামিম ইতিহাসে ঠাঁই করে নেন ১৯৭৭ সালে প্রথম বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে নেতৃত্ব দিয়ে। আইসিসির সহযোগী সদস্যপদ পেতে বিসিসিবি একাদশ নামে বাংলাদেশ দল একটি সিরিজ খেলেছিল ইংল্যান্ডের মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব এমসিসির সঙ্গে। সেই সিরিজে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেওয়ার পর অনুজদের সুযোগ করে দিতে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন শামীম কবির। পরবর্তী সময়ে বিসিসিবির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে কাজ করেছেন। সমসাময়িকদের দাবি, শামিম হতে পারতেন অনেক বড় কিছু। এমনকি দেশের ক্রীড়ামন্ত্রীও। কিন্তু নিভৃতচারী এই মানুষটির ছিল না সেই মোহ। শেষ বয়সে অসুস্থতার কারণে এড়িয়ে চলতেন সবাইকে। ক্রিকেটকে পুঁজি করে যখন অনেকে নিজেদের জাহিরে ব্যস্ত, তখন প্রথম অধিনায়ক ছিলেন সংবাদমাধ্যমের নাগালের বাইরে।

আজাদ বয়েজ কিংবা আঞ্চলিক দল, উদ্বোধনী জুটিতে শামিম কবিরের সঙ্গী ছিলেন আরেক সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান। ১৯৭৭ সালে প্রথম বাংলাদেশ ক্রিকেট দলেও শামিমের উদ্বোধনী সঙ্গী রকিবুলের কাছে তার স্থান তাই সবার ওপরে, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেটের রোল মডেল শামিম কবির। তিনি ছিলেন আপাতমস্তক একজন ভদ্রলোক। পাশাপাশি অনেক বেশি ডিসিপ্লিনড। তার কাছে ডিসিপ্লিনের জন্য কত যে বকা খেয়েছি জীবনে। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে থেকেই তার সঙ্গে খেলতাম আজাদ বয়েজে।’ রকিবুল আরও বলেন, ‘আমি তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। তখন থেকেই নিয়মিত আজাদ বয়েজে প্র্যাকটিস করি। অল্প বয়স বলেই নিয়মিত খেলার সুযোগ পেতাম না। একবার অনেকে আসেনি বলে শামিম ভাই ডেকে আমাদের দলে নিলেন। সাত নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ২৭-২৮ রানে অপরাজিত থাকলাম। এরপর আরেকদিন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, আমার সঙ্গে তুই ওপেন করবি। আমি আসলে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। কিছুটা আতঙ্কিতও হয়ে পড়েছিলাম। তিনি সাহস দিলেন। সেই ম্যাচে শামিম ভাই সেঞ্চুরি করলেন, আমি ৭০ প্লাস একটা স্কোর করলাম। এরপর অনেক ম্যাচে তার সঙ্গে ওপেন করেছি। শামিম ভাইয়ের মৃত্যু বড় এক শূন্যতা হয়ে এসেছে এ দেশের ক্রিকেটে।’

রকিবুল, সালাউদ্দিনের আরও আগে থেকে শামিম কবিরের সতীর্থ ছিলেন শফিকুল হক হীরা। জাতীয় দলের আরেক অধিনায়ক জানান, শামিম এবং তিনি অল পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-২৫ দলের হয়ে খেলেছেন। শামিমের মতো হীরাও ছিলেন উইকেটকিপার। বয়স হয়ে যাওয়ায় একদিন হীরাকেই গ্লাভস জোড়া তুলে দেন তিনি, ‘শতভাগ জেন্টেলম্যান বলতে যাকে বোঝায় তিনি ছিলেন শামিম ভাই। তার চালচলন ছিল বিলেতি সাহেবদের মতো। অনুশীলনে, ম্যাচে পরিষ্কার কাপড় না পরলে, জুতো পলিশ করা না থাকলে খুব রাগ করতেন। ১৯৮২ সালে তিনি ঢাকা ক্লাবের সভাপতি হন। এর কিছুদিন পর দ্বিতীয় আইসিসি ট্রফিতে আমি যখন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক তখন তিনি ছিলেন আমাদের দলের ম্যানেজার। আসলে শামিম ভাইয়ের কাছ থেকে শেখার শেষ নেই। তার মতো সোজা ব্যাটে খেলা ক্রিকেটার আমি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে দেখিনি।’

এ দেশের মানুষ এখন ক্রিকেট বলতে অজ্ঞান। চার দশক আগে এই খেলাটিকে এ দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে যাদের ছিল বড় অবদান, তাদেরই একজন শামিম কবির। তার চলে যাওয়া বাংলাদেশের ক্রিকেটের তারা ঝলমলে আকাশ থেকে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের খসে পড়া যেন।

প্রিন্ট নিউজ